অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গোয়েন্দাদের দক্ষতার মধ্যে সাদৃশ্য আছে। প্রতিটি অনুসন্ধান একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়। সাংবাদিক প্রথমে একটি হাইপোথিসিস বা অনুমান দাঁড় করান। তারপর আরও গবেষণা করেন: প্রচুর নথিপত্র খুঁজতে থাকেন, বিভিন্ন সাক্ষাৎকার নেন, যা কখনও কখনও জিজ্ঞাসাবাদের মতো মনে হতে পারে, এবং প্রচুর স্বাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করেন- যার কিছু কিছু অত্যন্ত বিশদ বা কারিগরী।
কোন সাক্ষ্যটি শেষ পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র প্রমাণ হিসেবে বৈধ বলে গণ্য হবে, তা যাচাইয়ের জন্য সাংবাদিকেরাও স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেন, ঠিক আদালতে যেমন হয়। যেহেতু মানহানির মত আইন আছে, তাই আদালতে মামলা চালানোর জন্য কোনো গোয়েন্দা যে ধরণের তদন্ত ও তথ্যের সত্যতা যাচাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন, একজন সাংবাদিকের তদন্তও তেমনটাই হতে হয়।
প্রশ্ন হলো, পরিচয় গোপন করে কিম্বা গোয়েন্দাদের মতো লুকানো মাইক্রোফোন বা ক্যামেরা ব্যবহার করা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের উচিত কি না? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা – বিশেষত এ ধারার সেরা রিপোর্টারদের কেউ কেউ – এসব কৌশল ব্যবহার করেন। কিন্তু মনে রাখা জরুরি, গোয়েন্দারা পরিচয় লুকিয়ে কাজ করবেন কিনা, এবং পুলিশি তদন্তের সময় নাগরিক কোন কোন অধিকার ভোগ করবেন – তা সাধারণত আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত থাকে। কিন্তু সাংবাদিক এধরণের কাজের বেলায় নিজের নৈতিক বোধের ওপর নির্ভর করেন। একইসাথে মাথায় রাখতে হয়, সাংবাদিকরাও ব্যক্তি-গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) আইনের আওতামুক্ত নন। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এ ধাঁচের কাজ করার আগে প্রতিটি পরিস্থিতিকে সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়, যাতে সাংবাদিকতার নৈতিক মান বজায় থাকে এবং আইনভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যায়। গোপন ক্যামেরা ও রেকর্ড কখনোই মূল স্বাক্ষ্যপ্রমাণের বিকল্প নয়, বরং তার সঙ্গে বাড়তি হিসাবে যুক্ত হতে পারে। মূল স্বাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ, তা যাচাই ও পটভূমি ব্যাখ্যার মাধ্যমেই প্রতিবেদন অর্থবহ হয়। উন্মুক্ত নথি (সরকার বা প্রতিষ্ঠান যেসব তথ্য সবার জন্য প্রকাশ করে রেখেছে) ঘেঁটেই ভুরি ভুরি প্রমাণ হাতে পাওয়া সম্ভব, শুধু জানা চাই কোথায় খুঁজতে হবে এবং কীভাবে এগুলোকে একটির সঙ্গে আরেকটিকে সংযুক্ত করতে হবে।
একজন গোয়েন্দা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজে অনেক মিল থাকলেও তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। কখনো কখনো সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধানের লক্ষ্য কাউকে দোষী প্রমাণ করা নয়, বরং শুধুই ঘটনার সাক্ষ্য দেওয়া। অপরাধ কে করেছে, তা প্রমাণ করতে পারলেই গোয়েন্দার কাজ শেষ হয়। কিন্তু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে শুধু অনিয়মকারীকে অভিযুক্ত করা হয় না, বরং নানা ঘটনার মধ্যে সংযোগও উন্মোচন করা হয়। ফলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শুধু অভিযুক্তের দিকে আঙুল তাক করে না, বরং ঘটনার প্রতিটি আঙ্গিক ও প্রসঙ্গের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ হাজির করে। নিজেদের কাজে এতোটা গভীরে যেতে পারলে রিপোর্টার কাজটির বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্নে সংশয়মুক্ত হতে পারে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ‘জার্নালিজম অব আউটরেজ’-ও (যে সাংবাদিকতা ক্ষোভ জাগায়) বলা হয়। অনুসন্ধানী রিপোর্ট দুই পক্ষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করে না। বরং যে প্রতিবেদন করা হবে, তার বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করাতেই এখানে বেশি জোর দেওয়া হয়। ‘আমাদের ভুল হতে পারে’, বা ‘আমাদের বুঝতে ভুল হতে পারে’-এমন ধরনের কোনো বাকচাতুরির সুযোগ এখানে নেই। এমন কোনো সন্দেহ থেকে থাকলে বুঝতে হবে যে, অনুসন্ধান যথেষ্ট গভীরে যায়নি এবং খবরটি এখনো ছাপার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। একটি রিপোর্টের কখনোই দুটি মাত্র দিক থাকে না। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভারসাম্যটি আসে বহু মতকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে এবং কী ঘটেছে -এর পাশাপাশি কেন ঘটেছে, তা তুলে ধরার মাধ্যমে। একজন গোয়েন্দা বিভিন্ন ঘটনাকে সূত্রবদ্ধ করে সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যার বিষয়টি অভিযুক্তের আইনজীবীর ওপর ছেড়ে দেন, সেখানে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে পুরোটাই ব্যাখ্যা করতে হয়।
অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অনেকটা বিজ্ঞানীর মতো কাজ করেন। একটি প্রতিবেদনের ধারণাকে সমর্থন করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ জড়ো করার আগ পর্যন্ত তাকে চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করার নীতিতে চলতে হয়। এর মানে হচ্ছে রিপোর্টারের ধারণার বিরুদ্ধে যায় এমন প্রমাণকে অগ্রাহ্য না করা এবং স্বাক্ষ্যপ্রমাণ ভিন্নদিক নির্দেশ করলে, উপসংহার বদলের মানসিকতা থাকা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ব্যবস্থাপকও বলা চলে। গভীর গবেষণা প্রয়োজন -এমন বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বিশেষজ্ঞসহ দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে রিপোর্ট-বিষয়ক পরিকল্পনার পেছনে লেগে থাকতে হয়। এ কারণে তাদের স্পষ্ট যোগাযোগ-কৌশলের পাশাপাশি দলীয়ভাবে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।