১. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কী?


পানামা পেপার্স, চার্চের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক যৌন নিপীড়ন নিয়ে বস্টন গ্লোবের উন্মোচন, ওয়াটারগেট; অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কথা চিন্তা করলে এই সামান্য কিছু উদাহরণই মাথায় আসে। এই প্রতিবেদনগুলো নাড়া দেয়, নতুন কিছু উন্মোচন করে, এবং কখনো কখনো পরিবর্তনও আনে।

কিন্তু এসব সাড়া জাগানো প্রতিবেদন কিভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে?

ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল যেমনটি বলেছেন, “সাংবাদিকতা হলো এমন কিছু প্রকাশ করা যা অন্য কেউ প্রকাশ করতে চাইবে না। বাকি সব কিছু জনসংযোগ।” সাংবাদিকতার বেশিরভাগ কাজে, এমনকি প্রতিদিনের ব্রেকিং নিউজের কাজেও অনুসন্ধানের উপাদান থাকে। কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলা যেতে পারে এমন কোনো কিছুকে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লম্বা সময় ধরে গভীর, বিশ্লেষণধর্মী কাজ করা হয়। এই কাজে কয়েক মাস বা বছরও লাগতে পারে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা একটি খবরের গভীরে গিয়ে তুলে আনেন দুর্নীতি, পর্যালোচনা করেন সরকারী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা, অথবা কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রবণতার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একা হোক বা দল বেঁধে – অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা একটি বিষয় নিয়ে গবেষণায় কয়েক মাস, এমনকি বছরও ব্যয় করতে পারেন। প্রচলিত খবরের ক্ষেত্রে যেখানে সাংবাদিকেরা সরকার, এনজিও এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোর সরবরাহ করা তথ্যের ওপর নির্ভর করে, সেখানে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে রিপোর্টার নির্ভর করেন, তার নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর। হয়তো তিনি অনেক নথিপত্রসহ কোনো ইমেইল পেতে পারেন বা দীর্ঘদীনের পরিচিত কোনো সূত্র তাঁকে কোনো কর্পোরেট ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানাতে পারে। যে কোনো ক্ষেত্রে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার লক্ষ্য হলো, জনস্বার্থে এমন কিছু উন্মোচন করা, যা ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছায় গোপন রাখা হয়েছিল।

জনস্বার্থ বোঝার একটি কার্যকর উপায় হলো, এমন কোনো বিষয় যা না জানার কারণে একটি জনগোষ্ঠী অসুবিধায় পড়ে, অথবা জেনে (বস্তুগতভাবে বা তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে) উপকৃত হয়। কখনও কখনও একটি জনগোষ্ঠী কোনো তথ্য জানার কারণে উপকৃত হলেও আরেকটি গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একটি উদাহরণ: বনজীবিরা যদি জানেন খোলা বাজারে কত চড়া দামে কাঠ বিক্রি হয়, তাহলে তারা কাঠব্যবসায়ীদের কাছে গাছের বেশি দাম চাইতে পারেন। কিন্তু, কাঠব্যবসায়ীরা চান কম দামে গাছ কিনতে। তাই তারা কাঠের বাজারমূল্য গোপন রাখতে চান, কারণ তা না হলে গাছের দাম বেড়ে যেতে পারে। একটি রিপোর্টের কারণে গোটা দেশকে উপকৃত হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আর প্রায়ই ‘জনস্বার্থ’কে ‘জাতীয় স্বার্থ’ থেকে আলাদা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা করা হয়। পরবর্তী বিষয়টি অর্থাৎ ‘জাতীয় স্বার্থ’ শব্দটি সরকার কখনও কখনও অবৈধ, বিপজ্জনক বা অনৈতিক কাজকে বৈধতা দিতে অথবা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার বিষয়ে সাংবাদিকদের রিপোর্ট করা থেকে নিরূৎসাহিত করতে ব্যবহার করে থাকে।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হুট করে হয় না। একে গড়ে তুলতে হয় ধীরে ধীরে – পরিকল্পনা, গবেষণা ও রিপোটিংয়ের একেকটি ধাপ পেরিয়ে, এবং তথ্য-প্রমাণের নির্ভুলতা নিশ্চিত করার স্বীকৃত মান মেনে। গবেষণা নানা রকম হতে পারে; তা সে ছদ্মবেশ ধারণ করা হোক, অথবা ডেটা মাইনিং করে একটি উপসংহারে আসা। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিছক সোর্সের দেয়া টিপ বা প্রাথমিক তথ্য যাচাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তাকে আরো অনেক দূর যেতে হয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন কিছু উন্মোচন করতে হয়, যা এতদিন অজানা ছিল, বা পুরনো তথ্যকে এমনভাবে সাজাতে হয় যেন তা নতুন কোনো তাৎপর্য তুলে ধরে। একক সোর্স থেকে আপনি চমকপ্রদ তথ্য পেতে পারেন, যে গোপন খবর সে না জানালে হয়তো আড়ালেই রয়ে যেত। কিন্তু সেই তথ্যকে যতক্ষণ না – নিজের সরেজমিন অভিজ্ঞতা, নথিপত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ – ভিন্ন ভিন্ন সূত্রের সঙ্গে যাচাই করা হচ্ছে এবং তার সত্যিকারের অর্থ জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে অনুসন্ধান বলা যাবে না।

রোজকার সংবাদ প্রতিবেদনের তুলনায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সম্পদ, জনবল এবং সময় – সবই বেশি লাগে। অনেক প্রতিবেদন দল হিসেবে করতে হয়। কিন্তু ছোট, স্থানীয় ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক গণমাধ্যমের জন্য বিষয়টি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য সময়, অর্থ, কর্মী এবং বিশেষায়িত দক্ষতা – সব কিছুরই ঘাটতি থাকে, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন অবস্থায় অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিতে একজন রিপোর্টারের অনুদান প্রয়োজন হতে পারে এবং তাকে বার্তাকক্ষের বাইরের বিশেষজ্ঞ দক্ষতা ব্যবহারের কৌশলও শিখতে হতে পারে।

দলগত কাজের পক্ষে ও বিপক্ষে কঙ্গোলিজ সাংবাদিক সেজ-ফিদেল গায়ালার বিশ্লেষণ: ‘ছোট দলে কাজ করার সময় নিশ্চিত করতে হয়, যেন প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর এক-একটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থাকে। একজন মাঠ পর্যায়ে মূল তদন্ত করবেন, অন্য আরেকজন গবেষণায় ও প্রামাণ্য উপাদান সংগ্রহে দক্ষ হবেন এবং তৃতীয়জন প্রতিবেদনটি লিখবেন। এতে একটি দলের পক্ষে দ্রুত কাজ করা এবং প্রতিবেদন সবার আগে সময়োচিতভাবে প্রকাশ করার ভালো সম্ভাবনা থাকে। তবে মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন দেশগুলোর যেসব বার্তাকক্ষে আমরা কাজ করি, সেখানকার পরিবেশ সব সময় স্বচ্ছ থাকে না। শিল্পখাত, ব্যবসা বা নীতিনির্ধারকদের পেতে রাখা ফাঁদে বার্তাকক্ষের অনেকেই পা দিয়ে থাকতে পারেন। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হুমকি বা ‘সাংবাদিক কেনার’ বিষয়ও থাকতে পারে। এমনকি আমাদের অনেক পত্রিকার নিজেদেরই সন্দেহজনক উৎস রয়েছে, যেখানে তারা শুরুতে এক বা একাধিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে কখনও কখনও সম্পাদকরা যেমন প্রাথমিক লক্ষ্যে পরিণত হন, তেমনই কখনও কখনও তাঁরাই প্রধান অপরাধীর ভূমিকা নেন। এই পরিস্থিতিতে যখন কোনো তরুণ সাংবাদিককে কাজ করতে হয়, তখন তার পক্ষে একটি অনুসন্ধানী প্রকল্প শেষ করতে অশেষ বাধার সম্মুখীন হতে হয়।’