৩. কীভাবে ভালো অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়া যায়?

৩. কীভাবে ভালো অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়া যায়?


অনুসন্ধানী সাংবাদিক হুট করে হওয়া যায় না। কিন্তু তাদের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলোর প্রতি যতœবান হোন, তাহলে দেখবেন আপনি আপনার পরবর্তী কোনো বড় প্রতিবেদনের পথে এগিয়ে গেছেন। এখানে থাকছে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

সাহস

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আপনাকে অনেক অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে। আপনি এমন সব গোপন বিষয় সামনে আনবেন যা অনেকেই চায় না। আপনি হয়তো কর্তৃপক্ষের চাপের শিকার হবেন। আপনার বস সেন্সরশিপ আরোপ করতে পারে, এমনকি কিছু সময় মৃত্যুর হুমকিও পেতে পারেন। এগুলোর মধ্যে টিকে থাকতে গেলে অনেক সাহস দরকার।

কৌতুহল

প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় সাংবাদিকতার মৌলিক পাঁচ ‘ডব্লিউ’ এবং এক ‘এইচ’ প্রশ্ন জিজ্ঞাস করার সক্ষমতা থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এই প্রশ্ন থাকতে পারে কোনো ঘটনায়, সংবাদে কিংবা দৈনন্দিন জীবনে যা শুনছেন বা দেখছেন, তার ভেতরেই।

আবেগ

সাংবাদিকতা করে আপনি হয়তো ধনী হতে পারবেন না। এবং এটি আপনার অনেক সময় ও শক্তি খরচ করবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়ার মানে আপনি হয়তো ক্ষমতাবান মানুষদের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন। এবং কিছু ক্ষেত্রে আপনার জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন। আপনি এই কাজটি করছেন, কারণ আপনার লক্ষ্য আরো বড়। সেটি হতে পারে সত্য উন্মোচন, ন্যায়বিচার বা হয়তো কোনো কণ্ঠহীনের কথা তুলে আনা।

উদ্যোগ

অনেক বার্তাকক্ষই চলে সীমিত সম্পদ নিয়ে এবং তাদেরকে নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে চলতে হয়। তাই কোনো সংবাদ সম্মেলনে পাওয়া অনুসন্ধানী আইডিয়াকে সব সময় রাতারাতি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না, বিশেষ করে যদি সেখানে তথ্যের ঘাটতি বা অস্পষ্টতা থাকে। অনুসন্ধানী সাংবাদিককে উদ্যোগী হতে হয়, করতে হয় নিজস্ব গবেষণা এবং সেই ধারণাকেই একটি রিপোর্টের জন্য পরিকল্পনা আকারে দাঁড় করাতে হয়। প্রতিষ্ঠান তারপরও আগ্রহী না হলে কাজটি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়ার (হতে পারে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল) উৎসগুলো খুঁজতে তাঁকেই উদ্যোগী হতে হয়।

বিচক্ষণতা

বেফাঁস কথা পুরো অনুসন্ধানকাজ এবং এর সঙ্গে যুক্ত সবার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। একই সঙ্গে এটি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সুযোগ করে দিতে পারে, যারা প্রতিবেদনটিই বাগিয়ে নিতে পারে কিংবা সম্ভাব্য সাক্ষাৎকারদাতাদের আগেই সতর্ক করে দিতে পারে। মনে রাখবেন: বেফাঁস কথায় জাহাজও ডোবে।

ন্যায্যতা ও নৈতিকতা

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তথ্য-সরবরাহকারী সূত্রের নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্র, এমনকি জীবনের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এমনকি কান্ডজ্ঞানহীন অভিযোগ এটি অভিযুক্তকেও একই ধরনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তাই একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের দৃঢ় ও সুচিন্তিত ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান থাকা জরুরি, যাতে তথ্যের উৎস ও প্রতিবেদনের কেন্দ্রে থাকা ব্যাক্তি – উভয়ের মর্যাদাই যতটা সম্ভব রক্ষা করা যায় এবং তারা ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষা পায়। পাশাপাশি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বার্তাকক্ষেরও একটি নৈতিক বিধির মধ্যে পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন, যাতে একই সঙ্গে নীতিগত প্রশ্নে কোনো সংশয় দেখা দিলে তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা থাকে।

যৌক্তিক চিন্তা, সংগঠন ও শৃঙ্খলাবোধ

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে সময় একটি বড় বিষয়। কখনো কখনো এতে আইনি ঝুঁকি থাকে। তাই সূক্ষ্মভাবে তথ্য যাচাই করা জরুরি। সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তাই আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে সতর্কতার সাথে। একই সঙ্গে সত্যতা যাচাই এবং বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠায়ও মনোযোগী হতে হবে।

বিস্তৃত সাধারণ জ্ঞান ও গবেষণায় দক্ষতা

সংশ্লিষ্ট ঘটনা, তথ্য ও প্রশ্নগুলোকে শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতার অনুধাবন পন্ডশ্রম এড়াতে সহায়ক হতে পারে। অনুসন্ধান যদি কোনো অজানা দিকে নিয়ে যায়, তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিককে অবশ্যই সেই দিকটির ইতিহাস, পরিভাষা, নিয়মাবলী ও মূল ব্যাক্তিদের সম্পর্কে দ্রুততার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা, সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বই শনাক্ত ও সংগ্রহ করে তা পড়া- এসবই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পড়ার অভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়তো জানেনই না, একটি খুব ছোট তথ্যও আপনার অনুসন্ধানে কতটা কাজে আসতে পারে।

নমনীয়তা

অনুসন্ধান অপ্রত্যাশিত দিকেও মোড় নিতে পারে। কখনো কখনো প্রথম প্রশ্নটি অন্ধ গলিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। আবার গৌণ প্রশ্নটিই আরও বেশি কৌতুহলোদ্দীপক, কিন্তু অবশ্যম্ভবী নয় এমন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কর্তব্য হচ্ছে নিজের গবেষণার বিষয়ে নতুন করে ভাবা ও নতুন পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুত থাকা এবং কোনোভাবেই প্রাথমিক ধারণায় বদ্ধমূল না থাকা।

দলীয় স্পৃহা ও যোগাযোগ দক্ষতা

চলচ্চিত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিককে প্রায়শই ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ হিসেবে দেখানো হয়। কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন গোপনীয়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং যথাযথ সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাওয়ার আগ পর্যন্ত যা অন্যদের জানানো যায় না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার্তাকক্ষের ভেতরের (এমনকি বাইরের) সব দক্ষতার সমন্বয় ও সহযোগিতাতেই সবচেয়ে ভালো রিপোর্টটি তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘স্পটলাইট’ নামের দলটির সাফল্যের কথা, যারা ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি নিয়ে অনুসন্ধান করেছিল। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও সমাজবিদ্যার মতো যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানের প্রয়োজন হতে পারে। আর জ্ঞানের পরিসর যত বড়ই হোক না কেন একজন সাংবাদিকের পক্ষে এই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিতজন এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ দলবদ্ধ কাজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকটি হলো ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা, যা অনুসন্ধানী উদ্যোগে অংশ নেওয়া সবাইকে প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য ও মানদন্ড (যথার্থতা, সততা, গোপনীয়তা ইত্যাদি) বুঝতে সাহায্য করে।


এই অধ্যায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংজ্ঞা ও জনস্বার্থে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকের পক্ষে তার সম্পাদককে অনুসন্ধানমূলক কাজে রাজি করানো সব সময় যে সহজ নয়, সেই বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানের সম্ভাব্য ফল কতোটা আশাপ্রদ হবে, এটি মূলত তার ওপরই নির্ভর করে। পরবর্তী অধ্যায়ে তাই খবরের বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া এবং ভুয়া তথ্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।