২.১. সাক্ষাৎকারের মৌলিক নীতিমালা


সময়মতো পৌঁছানো

আপনি দেরিতে পৌঁছালে সূত্রের সঙ্গে আপনার দূরত্ব তৈরি হবে। আপনার নিজের সময় নষ্ট হবে, ক্ষমা চাওয়ার জন্য সময় ব্যয় হবে এবং সাক্ষাৎকারের শুরুতে হয়তো আপনার দম থাকবে না; হাঁপাতে হাঁপাতে মূল বিষয়ে মনোযোগ রাখা সম্ভব হবে না।

উপযুক্ত পোশাক পরিধান করুন

পোশাক পরিধানের নিয়মনীতি এখানে যথেষ্ট শিথিল হলেও প্রথম দর্শনেই আপনার সম্পর্কে সূত্রের একটা খারাপ ধারণা হোক, তা নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না। প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক পরতে পারেন। উপযুক্ত শ্রদ্ধা দেখাবেন। পোশাকে আপনার জীবনাচারণ বা মতাদর্শ সম্পর্কে যেন কোনো বার্তা না থাকে।

কোথায় বসবেন, ঠিক করুন

আপনার এমন একটা স্থানে বসা দরকার, যেখান থেকে চোখাচোখি ভালো হবে এবং সেরকম জায়গা বেছে নিতে প্রয়োজনে আপনার রেকর্ডিং ডিভাইসকে একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন (যেমন, এটা এই স্থানে রাখলে অধিকতর ভালোভাবে রেকর্ড হবে…)। আবার, একেবারে মুখোমুখি বসলে দুজন দ্বন্দ্বে লিপ্ত, এমন মনে হতে পারে। বরং আপনি সমান্তরালে, বিপরীত স্থানে বসুন। কিন্তু কিছুটা কৌণিক করে বসবেন। দুজনের মাঝে যেন কোনো বস্তু না থাকে, সেটা নিশ্চিত করুন। যেমন, বইয়ের স্তপ, একটা খোলা ল্যাপটপ ইত্যাদি। নরম সোফায় বসলে লেখার কাজটা কঠিন হয় এবং আরামে গাঁ এলিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

উপযুক্ত চোখাচোখি বজায় রাখুন

সামনে থাকা মানুষটার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পেলে সবসময় আলাপচারিতা ভালো হয়। আপনি যদি নোট নিতে থাকেন, তাহলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে, কিন্তু, মাঝেমধ্যেই তাঁর দিকে তাকানোর চেষ্টা করুন। আর যখন প্রশ্ন করবেন তখন অবশ্যই তাকাবেন। আপনি কখনোই প্রশ্নমালা টানা দেখে পড়বেন না। সেটা হলে আপনার সূত্র সন্দেহ করবেন, আপনি সাক্ষাৎকার গ্রহণে অত্যন্ত কাঁচা, আপনি আত্মবিশ্বাসী নন অথবা আপনার সূত্র যা বলছেন তাতে আপনি প্রকৃতপক্ষে মনোযোগ দিচ্ছেন না। এটাকে আপনার রূঢ় আচরণের আলামত হিসেবেও নেওয়া হতে পারে এবং সূত্র কথা বলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

শারিরীক অভিব্যক্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকুন

রক্ষণাত্মক অঙ্গভঙ্গি ও চালচলন সংকেত দিতে পারে কৌশলে এড়ানোর চেষ্টাকে। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন কোথায় আপনার প্রশ্নটা আরও কঠিনভাবে করা দরকার। আপনার সূত্র কখন আঘাত পাচ্ছেন, কখন স্বস্তিবোধ করছেন, কখন রসিকতায় মজছেন, কখন রাগান্বিত হচ্ছেন বা বিরক্তিতে পড়ছেন এসব বিষয়েও খেয়াল রাখুন।

অন বা অফ দ্য রেকর্ড

‘অন দ্য রেকর্ড’ মানে আপনার সূত্র আপনাকে যা যা বলেছেন, তার সবই আপনি ব্যবহার করতে পারেন। ‘অফ দ্য রেকর্ড’ মানে আপনি এই তথ্য কেবল ব্যবহার করতে পারবেন, সেসব উপায়ে যেখানে সূত্রের পরিচয় অপ্রকাশিত থাকবে। আর ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ওনলি’ মানে আদৌ এই তথ্য ব্যবহার করবেন না। এটা কেবলই আপনি যাতে প্রেক্ষাপটটা বুঝতে পারেন, সেই জন্য বলা। এই ‘অন দ্য রেকর্ড’ বা ‘অফ দ্য রেকর্ড’ মানার ক্ষেত্রে কোনো আইগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু এটা সাংবাদিক ও সূত্রের মধ্যে একটা সাধারণ সৌজন্যতা।

এই সাক্ষাৎকার ‘অন দ্য রেকর্ড’ বা ‘অফ দ্য রেকর্ড’ তা সূত্রের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিন। সংবেদনশীল বিষয়ের ওপরে প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে সজ্ঞান সম্মতি নিশ্চিত করুন। সাক্ষাৎকারটা যদি অনানুষ্ঠানিক হয়, তাহলে আপনার নোটবুক ও রেকর্ডার বের করে, ‘বলুন আমি যদি এই কথোপকথন রেকর্ড করি বা নোট গ্রহণ করি, তাতে তাঁর কোনো আপত্তি আছে কিনা?’ সাক্ষাৎকারটা যদি আনুষ্ঠানিক হয়, দ্রুত কাজটা সেরে নিন এবং আপনার সময়টার উপযুক্ত ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, নোট নেওয়া বা রেকর্ড করার কথা শুনলে কোনো কোনো সূত্র ভয় পেতে পারেন। রেকর্ডিংয়ের ডিভাইস লুকিয়ে রাখবেন না। জ্ঞাতসারে লিখুন বা রেকর্ড করুন। সূত্র যদি স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করেন, অথবা আপনাকে এটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে ব্যাখ্যা করে বলুন যে এটা কিভাবে আপনার উত্তরগুলো সঠিকভাবে লিখতে সাহায্য করবে।

সব সময়ই নোট নিন

নোট নিলে মূল বিষয়ের ওপরে মনোযোগ নিবদ্ধ থাকবে। এর ফলে অঙ্গভঙ্গি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অভিব্যক্তি নথিভূক্ত রাখতে আপনাকে সাহায্য করবে, যা হয়তো আপনার রেকর্ডারে ধারণ করা সম্ভব না। রেকর্ডিংয়ে কোনো সমস্যা হলে এটা একটা ব্যাক আপ হিসেবে থাকবে। সঠিকভাবে নোট নিন, যাতে উদ্ধৃতি, আপনার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মধ্যে যেন স্পষ্ট পার্থক্য টানা যায়।

নিরপেক্ষ, উন্মুক্ত প্রশ্ন করুন

মনোবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে একটা পরামর্শ নিন। এমন প্রশ্ন এড়িয়ে চলুন, যার উত্তরে আপনার অনুভূতি কী হবে, আগেই তার ধারণা পাওয়া যাবে। এমন প্রশ্ন এড়িয়ে চলুন: ‘এটা কী নিতান্তই ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা নয়? ’। এর পরিবর্তে প্রশ্ন করুন: ‘ক্ষমতার এমন ব্যবহারের বিষয়ে আপনার মতামত কী?’ আপনি হয়তো আপনার সূত্রের উদ্দেশ্য বুঝতে চাইছেন। কিন্তু সরাসরি ‘কেন’ এমন শব্দ ব্যবহার করবেন না। কারণ, এটা হয়তো অভিযোগ তোলা বা অবিশ্বাস বলে মনে হতে পারে। সুতরাং ‘কেন’ প্রশ্নটা পরোক্ষভাবে করুন। ‘গণমাধ্যমের এই খবর আপনাকে কেন ক্ষুব্ধ করল’ না বলে বলুন, ‘আপনি বললেন যে গণমাধ্যমের এই খবর আপনাকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ বিষয়ে আমাকে আরও কিছু বলুন’।

নীরবতা খারাপ কিছু নয়

আপনার সূত্রকে প্রশ্নের উত্তর বলতে দিন। পরবর্তী প্রশ্নে যাওয়ার আগে কিছুটা বিরতি দিন। আলাপচারিতায় আপনি শূন্যস্থান পূরণ করতে যাবেন না। যদি সাক্ষাৎকারদাতা একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চিন্তার জন্য সময় নিতে চান, নিতে দিন; আবেগপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হতে সময় নিতে চাইলে আপনি অপেক্ষা করুন। পরে শুরু করুন এই প্রশ্ন দিয়ে: “আমরা কী এখন সামনে এগোতে পারি?”

চেহারায় আগ্রহ ফুটিয়ে তুলন, আগ্রহী হোন

সাক্ষাৎকারের সময় আপনি যা শুনছেন, তার সাথে অব্যাহত মিথস্ক্রিয়ায় থাকতে হবে। উত্তর যা পাচ্ছেন লিখে ফেলুন এবং সেখান থেকে বাড়তি প্রশ্ন বের করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি যে উত্তর চাই, এটা কি সেটা? আমি কী এটা বুঝেছি? অমি এটাকে কীভাবে ব্যবহার করব? একবার সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয়বারের জন্য সেখানে ফিরে যাওয়া খুবই কঠিন। আপনি যথেষ্ট গবেষণা করে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়ার পর দেখলেন নানাভাবে চেষ্টা করেও আপনি যা প্রত্যাশা করে আছেন আপনার সূত্র তা বলছেন না। উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। বিষয়টি ছেড়ে দিন। অথবা বিষয়বস্তু বদলে নিন। নতুন বিষয়ের দিকে এগিয়ে যান। নতুন প্রেক্ষাপটের ওপরে সাড়া দিন এবং ফলো-আপ জেনে নিন। আগে থেকে তৈরি হওয়া ধারণানির্ভর বিবরণ বা স্টোরির মধ্যে সূত্রকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বরং, আপনি অপ্রত্যাশিতভাবে যা পেলেন তা অধিকতর ভালো স্টোরির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদি সেটা না হয়, তাহলে আপনি পরবর্তীতে আপনার আসল বিষয়বস্তুর দিকে ফিরে যেতে পারবেন। আপনার সূত্রের সঙ্গে আগ্রাসী মনোভাব দেখাবেন না। সাক্ষাৎকারটা যদি আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী সঠিক পথে না এগোয়, তবুও না। এমনকি সাক্ষাৎকারদাতা রূঢ় আচরণ করলেও নয়।

সময়কে শ্রদ্ধা দেখান

ঘড়ির কাটার দিকে চোখ রাখুন। প্রশ্নের গতি ঠিক রাখুন। প্রতিশ্রুত সময়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলে বলুন, “আরও কয়েকটি প্রশ্নের জন্য আমাদের কী সময় হবে?”
সাক্ষাৎকারের ইতি টানার সময় এরপরে কী ঘটবে সে বিষয়ে সাক্ষাৎকারদাতাকে নিশ্চিত করুন। বলতে পারেন, “এই খবরটা বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।” তবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেবেন না যা আপনি রাখতে পারবেন না। যেমন, খবরটা প্রকাশের আগেই তাঁকে দেখার সুযোগ করে দেবেন, এমন প্রতিশ্রুতি।

খবর যা, তা-ই বলুন

ভালো সাংবাদিকেরা সূত্র থেকে পাওয়া উপাদানগুলোকে সততার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। স্পষ্টতই, সাক্ষাৎকারের সময় যা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনার মিথ্যাচার করা উচিত হবে না। সাক্ষাৎকারের পর কোনো প্রশ্নের বা তার জবাবের অর্থ আপনি উল্টে দিতে পারেন না। কোনো উদ্ধৃতিকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিতে পারবেন না। আসল সাক্ষাৎকারে যে ধারাক্রমে উত্তরগুলো এসেছিল, সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন। আনাড়িভাবে দুটো বিষয় পাশাপাশি স্থাপনের সময় সত্যটাকে দূর্ঘটনাবশত বিকৃত করে ফেলা খুবই সহজ। আপনার স্টোরিটা বলুন। এরপর স্টোরিটা যাদের বিষয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরুন। পাঠক-শ্রোতা-দর্শকেরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান; সত্যটা কোথায় আছে, তা ঠিকই তাঁরা ধরে ফেলবেন।