২.২. অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার কীভাবে ভিন্ন?

২.২. অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার কীভাবে ভিন্ন?


সব ধরনের সাক্ষাৎকারের জন্যই প্রস্তুতি ও নমনীয়তা দরকার। কিন্তু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ভিন্ন ধরনের কিছু জিনিস প্রয়োজন হয়, যেটি হয়তো আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ধরনের ওপরও প্রভাব ফেলবে। কাজের নিজস্ব চরিত্রের কারণে আপনি হয়তো আপনার সূত্রের কাছ থেকে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ পেতে পারেন। বা হয়তো তিনি রক্ষণাত্মক হয়ে যাবেন বা আপনাকে এড়িয়ে চলবেন। এখানে থাকছে অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকারের জন্য এমন কিছু বিবেচ্য বিষয়।

উপযুক্ত সময়জ্ঞান

আপনি অনুসন্ধানের কোন পর্যায়ে গিয়ে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মূল ব্যক্তিদের মুখোমুখি হবেন? খুব তাড়াতাড়ি হলে তারা আগেভাগেই সতর্ক হয়ে যাবেন, অথবা প্রতিবেদন প্রকাশ ঠেকাতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আরোপের উপায় খুঁজবেন বা তথ্যপ্রমাণ লুকিয়ে ফেলবেন। আবার, খুব দেরিতে হলে তাঁরা হয়তো তার আগেই পালিয়ে যাবেন, আপনার প্রশ্নের একটা সাদামাটা বা চতুর উত্তর তৈরি করে নেবেন, অথবা আপনার প্রশ্নের উত্তর এড়াতে আইনি ফাঁকফোঁকর বের করে ফেলবেন। তাই আপনার উচিত হবে, কেন্দ্রীয় চরিত্রদের কাছে যাওয়ার আগে যত বেশি পরিমাণে সম্ভব তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা। সেটি বিভিন্ন নথিপত্রও হতে পারে, বা কয়েক জায়গা থেকে নিশ্চিত হওয়া কোনো তথ্যও হতে পারে। এভাবে আপনার হাতে অনেক তথ্যপ্রমাণ আসবে, যার ওপর নির্ভর করে আপনি প্রতিবেদনটি তৈরি করবেন।

সুরক্ষাহীনতা

যদি আপনার স্টোরি পুরোপুরি তৈরি বা সঠিক নাও হয়, তারপরও আপনি হয়তো ‘কিছু একটার ওপরে’ কাজ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে, আপনি মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করলে আপনি যে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত করছেন, তাঁরা বা ক্ষমতাবান লোকজন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে দেবে। তাঁরা বুঝতে পারবেন যে আপনি তাঁদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেন। তাঁরা তখন যেকোনো ধরনের পথ অনুসরণ করতে পারেন। সাধারণভাবে অস্বীকার করলে তা মোকাবেলা করা সহজ এবং আপনি আপনার অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু, নানা ধরনের হুমকিও আসতে পারে। যেমন, সরাসরি শারীরিক হামলা, মামলার হুমকি, অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের (প্রায়ই আপনার সম্পাদক বা প্রকাশক) মাধ্যমে ভয় দেখানোর মত সুক্ষ্মতর কিছু। সংবাদটি প্রকাশের ওপর আইনী ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। আর এসব কিছুর কেন্দ্রে থাকবে ‘মানহানি’ শব্দটি, যদিও প্রায়শই মানহানির মামলা হয় না।

বিচক্ষণতা

যেসব বিষয় অজানা সেগুলোকে আলোর মুখ দেখানোই অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের লক্ষ্য। হতে পারে অজানা বিষয়টি নিয়ে সবাই ইচ্ছে করে মিথ্যা বলছেন, অথবা জেনেশুনে নীরব থাকছেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন মন্ত্রী সংসদে দরিদ্র তরুণীদের পাচার নিয়ে মিথ্যা বলেছেন। কিন্তু এই বিষয় নিতে তিনি আপনার সাথে আলোচনা করতে রাজি নন। আপনার অনুসন্ধানের ফলাফলটা সাড়া জাগানো না হলেও, চমকপ্রদ হবে। এমন অবস্থায়, তার সাক্ষাৎকার নিতে হবে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে। শুরুতেই যদি আপনি সাক্ষাৎকারে যা চাইছেন তা প্রকাশ করে দেন, তাহলে সূত্র হয়তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানাবেন। আপনি যদি সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থানটার কথা প্রচার করেন,তাহলে আপনি হয়তো সাক্ষাৎকারদাতাকে বিপদের মুখে ফেলবেন।

সাক্ষাৎকারের কৌশল ঠিক করা

একটা সাধারণ সাক্ষাৎকারের তিনটা সম্ভাব্য কৌশল রয়েছে। যখন আপনি পটভূমি বা তথ্য নিশ্চিত করার জন্য সাক্ষাৎকার নেবেন, তখন প্রশ্নগুলো খুব একটা কঠিন হবে না। আলাপ এগুতে থাকবে, কিন্তু প্রশ্নগুলো খুব বেশি ধীরে ধীওে আরো সংবেদনশীল বা কঠিন হয়ে উঠবে না। আর কোনো ব্যক্তির জীবন-কর্ম নিয়ে সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে প্রশ্নমালার শুরুটা হবে সেই ব্যক্তির ওপরে সংকীর্ণ পরিসরে মনোযোগ স্থাপনের মাধ্যমে, যেমন, তিনি কোন স্কুলে পড়েছেন? কাকে বিয়ে করেছেন এবং কেন? কীভাবে তাঁরা কবিতা লিখতে শুরু করেন? এখানে কিছু কিছু বদ্ধ প্রশ্নও করা হয়, যেখানে সেই ব্যক্তির জীবন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বর্পূণ তথ্য উঠে আসে। কিন্তু আপনার পাঠকেরা সেই ব্যক্তির মতাদর্শের বিষয়েও জানতে আগ্রহী। সুতরাং সাক্ষাৎকারটি যতটা এগোতে থাকবে, এটা কে ততই তার পরিসর বিস্তৃত হতে থাকবে। আধুনিক উপন্যাসের অবস্থা সম্পর্কে তিনি কী মনে করেন? তিনি কী সাহিত্য পুরস্কারগুলোতে বিশ্বাস করেন এবং তিনি চলতি বছরের মনোনীত ব্যক্তিদের বিষয়ে কী মনে করেন? এই ধরনের সাক্ষাৎকার অনেকটা ট্রাম্পেট (একধরনের বাদ্যযন্ত্র) বাজানোর মতো। এটা সংকীর্ণ একটা পথ দিয়ে শুরু হবে। এরপর ধীরে ধীরে বৃহৎ পরিসরের দিকে যাবে। সাক্ষাৎকার যত এগোবে, ততই বেশি খোলামেলা প্রশ্ন শুরু হবে।

অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো কৌশল নিতে হয়। এটার শুরু হয় বড় ও সাধারণ ইস্যুগুলো দিয়ে (যেমন, সরকারি টেন্ডার প্রদানের জন্য প্রক্রিয়াটা কী? এই প্রক্রিয়াটা কী সন্তোষজনক? সরকার কীভাবে এটার ওপর নজরদারি করে?) আর সাক্ষাৎকার যতই এগুতে থাকে ততই তা খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগী হয়। অনুসন্ধানমূলক সাক্ষাৎকারের চূড়ান্ত ও কঠিন প্রশ্নগুলো প্রায়ই হয় সুনির্দিষ্ট, অনেকটা হাঁ বা না জবাবের মত ( ক্লোজড কোশ্চেন)। যেমন, “বিশেষ এই চুক্তির ক্ষেত্রে কী আপনি টেন্ডার প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করেছেন? কেন?” আপনি এই প্রশ্নগুলো শেষে করবেন। কারণ, এটা সেই জায়গা, যেখানে আপনার সূত্র হয়তো থেমে যাবে। এরপর তিনি হয়তো আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইবেন না। এই সাক্ষাৎকারের কাঠামোটা হয় একটা চিমনির মতো। এটা শুরু হয় বড় পরিসরে, কিন্তু, শেষ হয় সংকীর্ণ জায়গায়।