১.৩.১ প্রতিবেদনের গঠন ও শৈলী


অনুসন্ধানমূলক, নিরেট সংবাদ বা ফিচার যাই হোক না কেন- রিপোর্টের জন্য মূলত তিনটি মৌলিক কাঠামো আছে:

  1. (১) সময়ানুক্রমিক – যেখানে সময়ের সাথে সাথে রিপোর্টটি ফুটে ওঠে, আর ক্রম ও ক্রিয়া এখানে তদন্তের উপাদান
  2. (২) বর্ণনামূলক – নির্দিষ্ট সময় ধরে একটি পরিস্থিতি অনুসরণের মাধ্যমে ঘটনা উন্মোচনের বিবরণ তুলে ধরে
  3. (৩) প্রক্রিয়াগত – যেখানে রিপোর্ট এগিয়ে চলে বিষয় ও যুক্তিগুলোকে ঘিরে

সমস্যা বা ইস্যু, কে বা কারা ক্ষতিগ্রস্ত, বিরোধ বা সংঘাত এবং আপনার অনুসন্ধানে পাওয়া বিষয়গুলো বাছাই করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আপনি লেখা শুরু করুন। তুলনামূলকভাবে সহজ ও সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে, কয়েক মাস বা বছরের বদলে যেটি কয়েক সপ্তাহেই শেষ হয়ে যায়, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভূমিকা ও উপসংহারসহ এই অংশগুলো আপনার চূড়ান্ত রিপোর্টের জন্য সন্তোষজনক একটি ছক তৈরি করে দিতে পারে।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখায় সাহিত্যিক নৈপুণ্য দ্বিতীয় স্থানে থাকে। কেন্দ্রে থাকতে হবে তথ্যউপাত্ত। যে কোনো ক্ষেত্রে, একটি ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিজে থেকেই লেখা হয়ে যায়। আপনাকে খুব বেশি সাজসজ্জা বা নাটকীয় রূপ দিতে হয় না।
অন্যান্য তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনের তুলনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দীর্ঘ ও জটিল হয়। তাই, একে নির্দিষ্ট গঠন ও কাঠামোর মধ্যে নেওয়া হলে আপনার পাঠকদের জন্য জটিল বিষয় বুঝে নেওয়ার পথ তৈরি হয়। অনুসন্ধানী রিপোর্টের বহুল প্রচলিত তিনটি কাঠামো:

(ক) ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ ফর্মুলার মধ্যে আছে:

  1. ১. একজন ব্যক্তি বা একটি পরিস্থিতি নিয়ে শুরু করে সেই কেইসের সাথে রিপোর্টের মূল বিষয়ের যোগসূত্র তৈরি।
  2. ২. একটি নাটগ্রাফ বা প্রতিবেদনের সারাংশের মাধ্যমে স্বতন্ত্র ঘটনা বা কেইস থেকে বৃহত্তর সমস্যার দিকে যাওয়া। এখানে নাট গ্রাফই ব্যক্তির সাথে বিষয়বস্তুর সংযোগ তৈরি করবে।
  3. ৩. যে ব্যাক্তির কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই ঘটনায় বা কেস স্টাডিতে ফেরা ও উপসংহার টানা।

(খ) ‘হাই ফাইভস’ পদ্ধতি তৈরি করেছেন লেখন-শৈলীর মার্কিন প্রশিক্ষক ক্যারল রিচ। তাঁর প্রস্তাব করা পাঁচটি বিভাগ:

  1. ১. মূল খবর (কী ঘটেছে বা ঘটছে)
  2. ২. প্রসঙ্গ (পটভূমি কী?)
  3. ৩. ব্যাপ্তি (এটি কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, স্থানীয় প্রবণতা নাকি জাতীয় সমস্যা?)
  4. ৪. সীমা (এটি কোথায় নিয়ে চলছে?)
  5. ৫. প্রভাব (আপনার পাঠকরা কেন এটিতে গুরুত্ব দেবে?)

পাঁচটি বিষয় একত্রিত করতে এই কাঠামোতে রুপান্তরমূলক লেখায় পারদর্শী হওয়া প্রয়োজন। এটি না হলে, মনে হতে পারে পাঁচটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট একের পর এক আসছে। কিন্তু ওয়েবসাইটের দীর্ঘ রিপোর্টের জন্য এরকম কাঠামো হতে পারে। সেখানে দীর্ঘ বর্ণনাকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয়, যেন পাঠকরা স্বচ্ছন্দে ধীরে ধীরে পড়তে (ব্রাউজ করতে) পারেন।

(গ) পিরামিড

নিরেট সংবাদ রিপোর্টের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি হলো ‘উল্টো পিরামিড কাঠামো’ (মূল বিষয়গুলো শুরুতে, পরে কম গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সব বিষয়)। অপরদিকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট পিরামিড কাঠামোর সঠিক দিকটি উপরে নিয়ে আসে। আপনার পুরো রিপোর্ট মূল বিষয়ের দিকে নিয়ে যাবে। আপনার উদঘাটন করা বিষয়গুলোর মধ্যে দিয়ে পাঠককে সেই মূল কথা বা উপসংহারে নিয়ে যেতে হবে।

  1. ১. রিপোর্টের মূলভাবের সংক্ষিপ্তসার দিয়ে শুরু করুন।
  2. ২. আপনি যা উদঘাটন করবেন তার কিছুটা পূর্বাভাস দিন।
  3. ৩. ধাপে ধাপে আপনার অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলুন, টেনশন জিইয়ে রাখুন এবং গল্পটিকে সবচেয়ে চমক দেওয়া বা নাটকীয় উদঘাটনের দিকে নিয়ে যান; ঠিক যেন কোনও বৈজ্ঞানিক সাফল্য অথবা রহস্য উপন্যাসের মতোই।
  4. ৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নাটকীয় তথ্যটি সবশেষে বলার জন্য তুলে রাখুন।

এই প্রতিটি সূত্র বা প্রণালীতে উপন্যাস রচনার কলা-কৌশল থেকে কিছু ধার নেওয়া হয়েছে। তাই, আপনি উপন্যাস সৃষ্টি না করলেও সাহিত্যের কিছু কৌশল প্রয়োগ করছেন। এটি সহজেই বোঝা যায় কারণ প্রতিটি সাংবাদিকই একজন কাহিনীরচয়িতা। শুধু ভালো নয়, সত্য কাহিনীর রচয়িতা হিসেবে নিজেকে দেখাই হলো সংবাদ লেখার আধুনিক পদ্ধতির ভিত্তি, যাকে আমরা বলি বর্ণনামূলক সাংবাদিকতা।

মার্কিনী গণমাধ্যমে ইরাক যুদ্ধের কাভারেজ নিয়ে “উইপনস অব মাস ডিসেপশন” নামে যে চলচ্চিত্রে এক ধরনের সতর্কবানী দিয়েছেন সে দেশেরই অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যানি স্কেচটার। তিনি গল্পবলার এই কাঠামোর একটি বড় সমস্যা তুলে ধরেন: বর্ণনামূলক ধারায় ব্যক্তির একক গল্প বলতে গিয়ে, অনেক বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও বিতর্ককে অগ্রাহ্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো। তবে, তার মানে এই নয় গল্প বলার বর্ণনামূলক ধারা খারাপ। বরং এটি মনে করিয়ে দেয়, অন্য যেকোনো লেখার পদ্ধতির মতোই গল্পকথনের (স্টোরিটেলিং) ধরণও সঠিক প্রেক্ষাপটে, সচেতনভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
বর্ণনামূলক সাংবাদিকতার কিছু কলা-কৌশলের মধ্যে আছে:

প্রতিকৃতি ও দৃশ্যায়ন: ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পদ্ধতিটি বেছে নিলে অনুসন্ধানের পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে সব খুঁটিনাটির ওপর আপনাকে গভীর নজর রাখতে হবে। অবশ্যই মূল উৎস বা দৃশ্যের বর্ণনা এমনভাবে দিতে হবে যেন পাঠকরা একে বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে। এর অর্থ আবার এই নয় যে, সবকিছুর বিরক্তিকর বর্ণনা দেবেন (জায়গার সংকট তো আছেই), বরং বেছে বেছে কিছু জাজ্বল্যমান বিবরণ নির্বাচন করুন, যা আপনার রিপোর্টকে সমৃদ্ধ করবে।

ইঙ্গিত ও আভাস: অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার সময়, আপনার গল্পটি পাঠকদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে – এ সম্পর্কে শুরুতেই তাদের ইঙ্গিত বা ধারণা দেওয়াও গুরুত্বর্পূণ। বিশেষ করে আপনি যখন পিরামিড কাঠামো অনুসরণ করেন। গল্পের শেষে চূড়ান্ত সত্য উন্মোচনের আগ পর্যন্ত একটু একটু করে বিবরণ জানাতে থাকবেন, যাতে পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়।

গতি, কাঠামো ও শব্দ: লেখার ক্ষেত্রে গতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণনার প্রতিটি পর্যায়ে যেধরণের কাঠামো ও শব্দ আপনি বাছাই করেন তা-ই ঠিক করে দেয় আপনার রিপোর্ট কতটা দ্রুত বা ধীরে এগোবে। সংক্ষিপ্ত বাক্য ও শব্দ গতি বাড়ায়। দীর্ঘ বাক্য এর গতি কমিয়ে দেয়। বাক্য ছোট হলেও একটি নিরেট অনুচ্ছেদে বিপুল পরিমাণ কারিগরি তথ্য পাঠকদের ধীরে যেতে বাধ্য করবে। অপ্রয়োজনীয়, বাড়তি পটভূমি আপনাকে গল্প শেষ হওয়ার অনেক আগেই তার গতিরুদ্ধ করে দেবে। সবসময়ই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: এটি কী কোনো মূল্য আছে নাকি নিছক কিছু বাড়তি শব্দ যোগ করছে? রিপোর্টের জন্য প্রয়োজন নেই এমন কথা বাদ দিন।

নিজের রিপোর্টটি শব্দ করে পড়লে আপনি বর্ণনার গতি ও প্রবাহ বুঝতে পারবেন। আরও বুঝবেন গল্পটি কোথায় গিয়ে ধীর হয়ে গেছে, অথবা আরো খারাপ হলে, কোথায় একঘেঁয়ে মনে হচ্ছে। আপনার কানই সবচেয়ে ভালো সম্পাদক এবং এটিই আপনাকে বলবে কোথায় আপনি লেখক হিসেবে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর হারিয়েছেন অথবা কোথায় আপনার ভাষা দীর্ঘসূত্রিতায় জড়িয়ে গেছে বা জটিল ও ভুল হয়েছে। রিপোর্টটি কথোপকথনের মতো করে লিখুন, যেন আপনি কাউকে গল্পটি বলছেন। এতে পাঠকরা আপনার কথার সুর বুঝতে পারবে। সঠিক ব্যাকরণ ও বিরামচিহ্ন লেখার মধ্যে সুর, শব্দের ওপর জোর ও সূক্ষ তারতম্য যোগ করে। কথা বলার সময় হাত, চোখ ও মুখের পেশী যে কাজ করে এগুলোও কাগজের ওপর সেই কাজটি করে।